হিজড়াদের মন ও মনন : নারী না-হয়েও হিজড়ারা নিজেদের
নারীরূপে ভেবে থাকে। মহিলাদের পোশাক-আশাক, মহিলাদের অলংকার-কসমেটিক-শৃঙ্গার
এদের পছন্দ অপ্রতিরোধ্য।ট্রেনে-বাসে লেডিস সিট, লেডিস
কম্পার্টমেন্ট, লেডিস ট্রেন, লেডিস
বাসে চড়ে বা উঠে যাতায়াত করে। ভুলেও এরা জেনারেল আসন বা কম্পার্টমেন্ট ব্যবহার করে
না। শেষ মুর্হূতে ট্রেনের জেনারেল কম্পার্টমেন্টে উঠে পড়লেও পরের স্টপেজে নেমে
লেডিস কম্পার্টমেন্টে ওঠে।পুজোর প্যান্ডেলে বা যাত্রার এদের মহিলাদের মধ্যেই দেখা
যায়। বস্তুত এরা নিজেদেরকে অম্বার জাত বা উত্তরসূরী ভাবে। অম্বা মহাভারতের একটি
অভিশপ্ত চরিত্র। গল্পটা একটু বলি : ভাই বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্য
স্বয়ংবর সভা থেকে ভীষ্ম অম্বাকে হস্তিনাপুরে নিয়ে এলেন। কিন্তু শাল্বরাজার প্রতি
অনুরাগের কথা শুনে ভীষ্ম অম্বাকে মুক্তি দেন। অপরদিকে শাল্বরাজ অম্বাকে গ্রহণ করতে
অস্বীকার করেন। এহেন ঘটনার অম্বা জোর গলায় ভীষ্মকে অভিযুক্ত করে। এখানেই শেষ নয়,
অম্বা ভীষ্মকে ধ্বংস করবে এমন বিধ্বংসী তপস্যায় ব্রতী হলেন। শিব
সন্তুষ্ট হয়ে অম্বাকে বর দিলেন। বললেন – এ জন্মে নয়,
পরজন্মে নপুংসক ‘শিখণ্ডী’ হয়ে অম্বা জন্মগ্রহণ করবেন এবং ভীষ্মের মৃত্যুর কারণ হবে। হিজড়ারা এই
কাহিনি জানে, জানে বলেই তারা নিজেদেরকে অম্বার সঙ্গে গভীর
একাত্মতা অনুভব করে। হিজড়ারা বিশ্বাস করে তারা নপুংসক শিখণ্ডী – এ জন্মের আগে তাদেরও ছিল স্বাভাবিক জীবন এবং পরের জন্মে আবার নারীজন্ম
ফিরে পাবে।
স্বাভাবিক কর্মজীবনে হিজড়াদের ভূমিকা : হিজড়াদের সেই ‘পরিচিত’ কর্মের বাইরে মূলস্রোতে কর্মরত অবস্থাতেও দেখা যাচ্ছে। কিছু খ্রিস্টান
সংঘ হিজড়াদের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। ইউনিটারিয়ান একটি উদার ধর্মমত।
তাদের মূল খ্রিস্টান ধর্মের সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭৯ সালে তারাই সর্বপ্রথম হিজড়াদের পূর্ণ সদস্য হিসাবে গ্রহণ করে। and the first to open an Office of Bisexual, Gay,
Lesbian, and Transgender Concerns in 1973. ১৯৮৮ সালে উইনিটারিয়ান
উইনিভার্সালিস্ট অ্যাসোসিয়েশান প্রথম একজন হিজড়া ব্যক্তিতে মনোনীত করে। ২০০২
সালে শ্যন ডেন্নিসন প্রথম হিজড়া ব্যক্তি যিনি ইউনিটারিয়ান ইউনিভার্সালিস্ট
মন্ত্রনালয়ে ডাক পান। ২০০৩ সালে ইউনাইটেড চার্চ অফ খ্রিস্ট সকল হিজড়া ব্যক্তিকে
অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে মত দেয়। ২০০৫ সালে ট্রান্সজেন্ডার সারাহ জোনস চার্চ অফ
ইংল্যান্ডের ধর্মযাজক হিসাবে নিয়োগ পান। ২০০৮ সালে ইউনাইটেড মেথোডিস্ট চার্চ
জ্যুডিশিয়াল কাউন্সিল রায় দেন যে ট্রান্সজেন্ডার ড্রিউ ফনিক্স তার পদে বহাল
থাকতে পারবেন। ওই একই বছরে মেথোডিস্টদের একটি সাধারণ বৈঠকে একাধিক হিজড়া ক্লারজির
বিরুদ্ধে পিটিশান খারিজ করে দেয়া হয়। ভারতের বিহারে ‘কালী
হিজড়া’ পশ্চিম পাটনা কেন্দ্র থেকে ‘জুডিসিয়াল রিফর্মস’ পার্টির প্রার্থী হিসাবে
দাঁড়িয়েছিলেন। ১৯৯৫ সালে পশ্চিমবাংলার টিটাগড় পৌরভোটে ১৪ নং ওয়ার্ড থেকে ‘হিজড়া’ বৈজয়ন্তীমালা মিশ্র ভোটপ্রার্থী
হয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালের লোকসভায় মহারাষ্ট্রের জালনা কেন্দ্র থেকে নির্দল হিজড়া
প্রার্থী রমেশ ওরফে মালা ভোটপ্রার্থী হয়েছিলেন।
উত্তর চব্বিশ পরগণার নৈহাটীর কারখানা শ্রমিক বাবার
মধ্যবিত্ত পরিবারে ছেলে হিসেবে জন্ম হয় সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। প্রাথমিক ও
মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে কলকাতার একটি কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক সম্পন্ন করেন তিনি।
পড়াশোনা শেষে পশ্চিমবঙ্গের মাওবাদী (ঝাড়গ্রাম) অধ্যুষিত অঞ্চলের এক কলেজে বাংলার
শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন তিনি। এ সময়েই নারী ও তৃতীয় লিঙ্গের অধিকারের প্রতি আকৃষ্ট
হয়ে লেখালেখি ও সামাজিক আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। পরে ২০০৩ সালে জটিল এক
অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে নিজেকে নারীতে রূপান্তরিত করেন সোমনাথ, এখন তিনিই মানবী
বন্দ্যোপাধ্যায়। ৫১ বছর বয়সি মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় এখন পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার
কৃষ্ণনগর মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ। ২০১৫ সালের ৯ জুন থেকে তিনি নতুন দায়িত্বভার গ্রহণ
করেছেন। ভারতে প্রথমবারের মতো তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া) একজনকে কলেজের অধ্যক্ষ পদে
নিয়োগ করা হয়েছে। (এই পোস্টের সঙ্গে যে ফোটোগ্রাফটি দেওয়া হয়েছে, ইনিই মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়) এটা তৃতীয় লিঙ্গদের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ
মাইলফলক।সম্প্রতি অনেকে নিশ্চয় লক্ষ করেছেন যে, ভারত
সরকারের একটি ট্র্যাফিক সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন হিজড়াদের দিয়ে করানো হয়েছে।তবে
বাংলাদেশে হাসিনা সরকার হিজড়াদেরকে ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগানো যায় কি না
ভাবছেন।
হিজড়াদের মৃত্যু ও সৎকার : সাধারণ মানুষের কাছে এ এক রহস্যজনক
অধ্যায়। কোনো রহস্য নেই, সবটাই উন্মোচিত। এদের প্রতি আমাদের চরম অবহেলা আর উদাসীনতাই রহস্য
ঘনীভূত হয়েছে। হিজড়াদের মৃতদেহ কেউ দেখেছে কি না এ প্রশ্ন অনেকসময় শুনতে হয়। উত্তর
সবার কাছে নেই, তাই ভ্যাবাচাকা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া
তেমন কিছু করারও নেই। বস্তুত হিজড়াদেরও মৃত্যু হয়, মৃতদেহও
হয়, মৃতদেহের সৎকারও হয়। মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে হিজড়াদের
শবযাত্রাও হয়। তবে তা নিঃশব্দে গভীর রাতে। শ্মশান বা গোরস্থানের কিছুটা আগে
মৃতদেহকে দাঁড় করানো হয়। এরপর চতুর্দিক থেকে মৃতদেহকে ঘিরে থাকে হিজড়ারা। তারপর
মৃতদেহকে কিছুক্ষণ হাঁটানো হয়। মৃতদেহকে কি হাঁটানো সম্ভব ? মোট্টেও সম্ভব নয়। অগত্যা টেনে হিঁছড়ে নিয়ে আসা হয়। শ্মশান বা
গোরস্থানে এসে নির্দিষ্ট জায়গায় শুইয়ে দিয়ে মৃতদেহকে উপর্যুপরি লাথি মারা হয়। লাঠিপেটাও
করা হয়। মৃতব্যক্তি যত বড়ো প্রিয় মানুষ হন না-কেন এই আচরণে অন হিজড়াদের একদম কাঁদা
চলবে না।নিয়ম নেই। হিন্দু হলে নগ্ন করে চিতার উপর শোয়ানো হয়, মুসলমান হলে মাটি দেওয়ার আগে মৃতদেহকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে স্নান করানোর
রীতি আছে। তবে পঞ্জাবের বেশ কিছু জেলায় মৃত্যুর পর বাড়ির ছাত সরিয়ে হিড়াদের বাইরে
বের করে আনা হয়। যাতে খোলা ছাতের মধ্য দিয়ে মৃতব্যক্তির আত্মা চিরতরে আকাশে বিলীন
হয়ে যায়।অপরদিকে মৃতব্যক্তি যদি গুরু-মা হন তবে হিন্দুদের বেলায় তার বড়ো মেয়ে বা
শিষ্য বা চেলা মুখাগ্নি করবে। মুসলমান হলে বড়ো মেয়ে বা শিষ্য বা চেলাই পারলৌকিক
সমস্ত ক্রিয়াকর্মের সম্পাদনের মূল দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়।এরপর কোথাও দীর্ঘ এক মাস
কোথাও-বা ৩৯ দিন ধরে চলে অশৌচ পর্ব। অন্য হিজড়া মহল্লার হিজড়ারও অশৌচ পালন করে,
তবে সেটা চারদিনের মাত্র।হয় শ্রাদ্ধানুষ্ঠানও, নিমন্ত্রণ রক্ষা করে হিজড়ারাই।
সেই প্রশ্নটাই আবার ঘুরে ফিরে এল। হিজড়া আর সমকামী কি
সমার্থক ? বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে হবে।আদিকাল থেকে সমকাল পর্যন্ত
শিল্প-সাহিত্যেও মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত অভিলাষ সমকামিতার প্রতিফলন। অথচ ভারতসহ
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আদালতের রায়ে সহস্রাব্দ প্রাচীন সমকাম আজ বিকৃত সমকামিতা
অপরাধ। গ্রিক সভ্যতা থেকে প্রাচীন ভারত। সমকামিতার উদাহরণ যুগে যুগে। প্রাচীন
নাগরিক সমাজ, ব্যক্তির স্বাধীনতা, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণা যেখানে জন্ম নিয়েছিল গ্রিসে। সেই গ্রিস,
যে কখনও নাগরিকের যৌন স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেনি। সমলিঙ্গ যৌন
সংসর্গের বৈধতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন ছিল না সেখানে। হেরোডেটাস, প্লেটোর মতো দার্শনিক-চিন্তাবিদদের লেখায় প্রায়ই পাওয়া যায় সমকামী
সম্পর্কের কথা। আনুমানিক খ্রিস্ট পূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে গ্রিসের লেসবস দ্বীপে
জন্মগ্রহণ করেছিলেন স্যাফো। এই মহিলা কবির লেখার প্রতিটি পরতে পরতে নারী শরীরের
বন্দনা। স্যাফোর জন্মস্থান লেসবস থেকেই তো অভিধানে জায়গা পেয়েছে লেসবিয়ান শব্দটি।
পাশ্চাত্য থেকে এবার আসা যাক প্রাচ্যে। ইতিহাস বলছে, প্রাচীন
পারস্যে সমকামী সম্পর্কের প্রচলন ছিল। যেমনটা ছিল, এই
ভারতবর্ষেও। বহু হিন্দু মন্দিরের দেওয়ালের ভাস্কর্য তো সমকামেরই অভিজ্ঞান। পুরাণে
বিষ্ণুর মোহিনী রূপ আর অর্ধনারীশ্বর শিব, মহাকাব্য-
পুরাণের পাতায় পাতায় যেন তৃতীয় লিঙ্গের সদর্প উপস্থিতি। এমনকী, বাতসায়নের কামসূত্রও বলছে সমকামিতা যৌন সম্পর্কেরই অন্য রূপ।
সমকামিতা বলতে আমরা সাধারন অর্থে বুঝি পুরুষের সঙ্গে
পুরুষের বা নারীর সঙ্গে নারীর যৌন সম্পর্ক। সমকামিতা কিন্তু যৌন সম্পর্কের উপর
নির্ভর করে না, এটা নির্ভর করে যৌন আকর্ষণের উপরে। একটি ছেলে কোনোদিন যৌন সম্পর্ক
করেনি, কিন্তু করলে সে একটি মেয়েকেই বেছে নেবে। সে
মেয়েদের প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ করে বা প্রেমে পড়ে। ছেলেটি যদি ঠিক তেমন আকর্ষণ
একটি ছেলের প্রতি অনুভব করে বা ছেলে হয়ে ছেলের প্রেমে পড়ে তখন সে সমকামী। যৌন
সম্পর্ক হোক বা না-হোক। মোদ্দা কথা হল -- সমকামিতা একটা পছন্দ, কাজ নয়। স্বাভাবিক যৌন আকর্ষণ সম্পন্ন ব্যক্তিকে, অর্থাৎ একজন নারী একজন পুরুষকে অথবা একজন পুরুষ একজন নারীর প্রতি
যৌন-আকর্যণ বোধ করলে, তাকে স্ট্রেইট (Straight) বলা হয়। সমকামিতা কিন্তু বিভিন্ন
ধরনের ধারণা আছে। এ সংক্ষেপে শ্রেণিবিভাগগুলি আলোচনা করে নিতে পারি বোঝার জন্য। এই
শ্রেণিবিভাগ করে হয়েছে একজন নিজেকে কী মনে করে ও কী পছন্দ করে তার উপর ভিত্তি করে।
(১) গে (Gay) : একজন পুরুষ নিজেকে পুরুষ মনে করে। পুরুষের পোশাক পরে এবং একজন পুরুষের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। এই ধরনের দুইজন পুরুষ বিয়ে করলে এদের মধ্যে স্বামীকে ‘টপ’ এবং স্ত্রীকে ‘বটম’ বলে।
(২) লেসবিয়ান (Lesbian) : একজন মেয়ে নিজেকে মেয়ে মনে করে। মেয়েদের পোশাক পরে এবং একজন মেয়ের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। এই ধরনের দুইজন মেয়ে বিয়ে করলে এরা পুরুষালি পোশাকে ও আচরণে একজন স্বামীর ভুমিকা পালন করে।
(৩) ট্র্যানি : একজন পুরুষ সে নিজেকে মেয়ে মনে করে। অথবা একজন মেয়ে, সে নিজেকে পুরুষ মনে করে। সে মনে করে সে ভুল দেহে জন্মেছে। এরা বিপরীত লিঙ্গের পোশাক পড়ে। অনেকে হরমোন প্রয়োগ ও অস্ত্রপচার করে দেহের পরিবর্তন করে বিপরীত লিঙ্গের হওয়ার চেষ্টা করে। মোদ্দা কথা এদের দেহ এক লিঙ্গের, কিন্তু মন আর-এক লিঙ্গের। যে-কোনো লিঙ্গের প্রতি এদের আকর্ষণ থাকতে পারে। তবে বেশির ভাগ হিজরা এই ‘ট্রানি’ ক্যাটাগরিতে পড়ে।
(৪) বাই (Bisexuality) : একটি ছেলে বা একটি মেয়ে, সে অপর কোনো ছেলে বা মেয়ে উভয়ের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। একটি ছেলে যে মেয়েদের প্রেমেও পড়ে আবার ছেলেদের প্রেমেও পড়ে। পর্নস্টার সানি লিওন বাইসেক্সচুয়াল। (চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন