লিঙ্গ কর্তনের পর আর-একটি প্রধান কাজ হল স্তন-দুটিকে
পুষ্ট করা। এটি হিজড়াসমাজের অত্যন্ত গোপনে হয়, যাকে বলে ট্রেড সিক্রেট। লিঙ্গ
কর্তনের কয়েকদিন পর নতুন হিজড়া একটু সুস্থ হয়ে উঠলে মহল্লার দলপতি তাকে Lyndiol (চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এই ট্যাবলেট
খাওয়া অনুচিত) নামে এক ধরনের জন্ম নিরোধক ট্যাবলেট খাওয়ায়।বেশ কয়েক মাস ধরে এই
ট্যাবলেট সেবন করানো হয় রোজ, নিয়মিত। এই ট্যাবলেটে ইথিলিন
অস্ট্রাডাইওলের পরিমাণ একটু বেশি থাকে। ফলে শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের পরিমাণ
বৃদ্ধি পায়। হরমোনের কু-প্রভাবে স্তনগ্রন্থিতে স্নেহজাতীয় পদার্থ সঞ্চিত হতে থাকে
এবং ধীরে ধীরে পুরুষ-বক্ষ থেকে নারী-স্তনের মতো স্ফীত ও পরিপুষ্ট হতে থাকে।
নারীদের মতোই স্তনবৃন্তও ফুলে ওঠে।তবে যাদের আর্থিক সামর্থ্য থাকে তারা
প্ল্যাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে স্তন প্রতিস্থাপন বা সিলিকন ব্রেস্ট করিয়ে নেয়।
খুবই ব্যয়সাপেক্ষ এই পদ্ধতি আমাদের দেশের মতো তৃতীয় বিশ্বে প্রায় অসম্ভব হলেও
ধনতান্ত্রিক দেশগুলির হিজড়ারা সিলিকন ব্রেস্ট বানিয়ে নেয়। তবে তারা কিন্তু সকলেই লিঙ্গ কর্তন করে না। পর্ন-দুনিয়ায় এদের বেশ কদর আছে। এরা “Shemale”বা “Ladyboy”। তবে সোমনাথ ওরফে মানবী মনে করেন, “মেয়ে হিজড়ে ছেলে
হিজড়ে বলে কিছুই নেই। সকলেই সমান হিজড়ে। হিজড়ে দলে দু-রকম মানুষ – আকুয়া আর নির্বাণ। আকুয়ারা পেনিস-টেসটিস এখনো কেটে ফেলে দেয়নি, আর নির্বাণ হল তারাই যারা কেটে ফেলে দিয়েছে”।
বহুচেরা মাতার (হিজড়াদের দেবতা) মন্দিরে ‘কমলিয়া’ নামে এক বিশেষ হিজড়া সম্প্রদায় আছে। এরা পুরুষ। এরা একই সঙ্গে নিজেদের
নারী ও পুরুষ হিসাবে কল্পনা করে। তাই লম্বালম্বিভাবে দেহের এক অংশে পুরুষের পোশাক
এবং অপর অংশে নারীর বেশ ধারণ করে। এই ‘কমলিয়া’ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।
হিজড়াসমাজের রীতিনীতি : সামাজিক মূলস্রোত থেকে এই সমাজ
সম্পূর্ণই বিচ্ছিন্ন। হিজড়াসমাজের রীতিনীতি , আচার-ব্যবহার, ধর্মীয় অনুশাসন সবই আলাদা। প্রত্যেক হিজড়া মহল্লায় একজন দলপতি থাকেন।
এরা ‘গুরু-মা’ বলে পরিচিত। এই
গুরু-মাই দলের অভিভাবক। গুরু-মায়ের আন্ডারে হিজড়ারা হল তার শিষ্য, চেলা বা মেয়ে। অবাধ্য হওয়া তো দূরের কথা, শিষ্যেরা
গুরু-মাকে খুবই মান্য করে।শিষ্য সংগ্রহ করা এবং তাকে নির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়ে কাজে
পাঠানো গুরু-মায়ের অন্যতম প্রধান কাজ। গুরু-মায়ের তত্ত্বাবধানে শিষ্যরা
নাচ-গান-বাজনা শিখতে থাকে। শুধু নাচ-গান-বাজনা শিখলেই হয় না, তালি দেওয়া শেখাটাও অত্যন্ত জরুরি।সবাই জানেন, হিজড়াদের তালি বিশেষ ধরনের। দুটি হাতের চেটোকে ৯০ ডিগ্রি কোণ করে এই
তালি দেওয়া হয়।
হিজড়া দুনিয়ার প্রচলিত রীতি অনুসারে প্রত্যেক গুরু-মায়ের
কাজের কিছু নির্দিষ্ট এলাকা থাকে। এই এলাকায় তিনিই হলেন হিজড়াদের বস। হিজড়া
মহল্লায় একজন গুরু-মায়ের অধীনে কতজন শিষ্য থাকবে তার কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। তবে
যেসব শিষ্যরা মহল্লায় স্থায়ীভাবে বসবাস করে তারা হল ‘সাধারণ শিষ্য’। একই গুরু-মায়ের সাধারণ শিষ্যেরা একে অন্যের গুরু-বোন। গুরু-মায়ের
অবর্তমানে তার সম্পত্তির সমান অংশ পায় শিষ্যেরা।তবে অনেক সময় মৃত্যুর আগেই গুরু-মা
তার সমস্ত সম্পত্তি কোনো একজন শিষ্যকে উইল করেও দিয়ে যান।
হিজড়াদের জীবনজীবিকা : স্বাভাবিক মানুষদের মতো হিজাড়ারাও
নানাবিধ পেশায় যুক্ত থাকে, যদিও সীমিত ক্ষেত্র। দেখা যাক -- (১) বাচ্চা নাচানোই এদের প্রধান
জীবিকা।সাধারণত বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে নবজাতকের জন্মের কথা ওরা জানতে পারে।
তারপর একদিন দলবল নিয়ে হাজির হয় নবজাতকের বাড়িতে।বাচ্চাকে কোলে নিয়ে শুরু হয়
নাচা-গানা। বাচ্চা নাচানোর পর ওরা যে টাকাপয়সা ও অন্যান্য দ্রব্য দাবি করে,
তা বেশিরভাগ সময়ই জুলুমের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। প্রাপ্য দাবি
না-মিটলে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি এবং অশ্রাব্য গালিগালাজ দিয়ে নবজাতকের পরিবারকে হেনস্থা
করতে থাকে।এই ঔদ্ধত্য ও দুর্বিনীত আচরণ শেষপর্যন্ত বাক্-বিতণ্ডা এবং হাতাহাতি
অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। বাচ্চা নাচিয়ে যে অর্থ উপার্জন হয় তার অর্ধেক গুরু-মা ও
অর্ধেক শিষ্যেরা পায়। অবশ্য কোনো কোনো অঞ্চলে উপার্জিত অর্থের এক-চতুর্থাংশ
শিষ্যেরা পায়।(২) গুরু-মায়েরা দালাল মারফৎ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে
সুশ্রী ‘নাগিন’ হিজড়াদের পাঠিয়ে
থাকে। দালালরা এদের নিয়ে তোলে ওইসব অঞ্চলের কিছু ব্যক্তির কাছে, যারা ‘মাস্টারজি’ নামে
পরিচিত।এই মাস্টারজিদের তত্ত্বাবধানে নাগিনরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হিন্দি ফিল্মি
দুনিয়ার চিত্তবিনোদক নৃত্য পরিবেশন করে।এইভাবে যে অর্থ উপার্জন হয় তার সিংহভাগই
মাস্টারজির পকেটে চলে যায়। গুরু-মায়েরও দালালদের মাধ্যমে এই অর্থের একটা বড়ো অংশ
লাভ করেন। (৩) মূল্য না দিয়ে বাজার থেকে সবজি-তরিতরকারি জোর করে তুলে নেয়। এই ‘তোলা’ তোলা ব্যবস্থা বহু বছর ধরে চলে আসছে।
আজকার দূরপাল্লার ট্রেনে ও বাসেও এদের তোলা তুলতে দেখা যায়।(৪) আন্তর্জাতিক
চোরাচালানের সঙ্গেও হিজড়ারা যুক্ত থাকে। বিভিন্ন স্মাগলার ডনদের আন্ডারে কিছু
গ্যাংলিডার আছে। সেই গ্যাংলিডারদের একটা বড়ো অংশই হিজড়া।(৫) হিজড়াদের একটা অংশ দেহ
ব্যাবসার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে অর্থ ও যৌনসুখের আশায়। সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ভাষায়,
“হিজড়াদের একমাত্র জ্বালা-যন্ত্রণা-প্রতিহিংসার বিষয় হল –
নরনারীর ‘স্বাভাবিক’ জীবন”।বেশ্যাপাড়ায় সত্যিকারের মেয়েদে হারিয়ে ‘পারিক’ হিজড়াদের হিজড়াদের চাহিদা বেড়েছে।কম
বয়সি হিজড়ারা ‘কলগার্ল’ হিসাবেও
এরা যৌনপেশায় লিপ্ত থাকে। হিজড়া মহল্লার বাইরে সমকামী অ্যাকটিভ পুরুষের কাছে
হিজড়াদের বেশ চাহিদা আছে। এরা নারীর স্থলাভিষিক্ত পুরুষ যৌনকর্মী। মুম্বাই শহরে
হিজড়াদের উপর বিশেষ অনুসন্ধান চালিয়ে ডাঃ ঈশ্বর গিলাডা এক সমীক্ষায় বলেছেন –
সেখানকার প্রায় ৬০ শতাংশ হিজড়া বেঁচে থাকার তাগিদে বেশ্যাবৃত্তির
সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
হিজড়াদের যৌনকর্ম : যৌনাঙ্গ বিকৃতির কারণে এরা অন্যভাবে যৌনক্ষুধা মেটায়। মূলত এরা পায়ুকামের (Sodomy) মাধ্যমে যৌনতা করে। মেয়েদের মতো Passive বা নিষ্ক্রিয় যৌনসঙ্গী হন। এরা সকলেই পায়ুমিলনে অভ্যস্ত। এই পায়ুপথই (Anal Canal) নারীর যৌনাঙ্গের (Vagina) সমতুল্য। শুধু রোজগারের জন্যই এইসব হিজড়ারা সমকামী কোনো ব্যক্তির সঙ্গে পায়ুমিলনে লিপ্ত হয় না, অবদমিত যৌনক্ষুধাকে তৃপ্ত করার জন্যও এরা সমকামে আসক্ত হয়ে পড়ে। মূত্রছিদ্র দিয়ে এক ধরনের রস নিঃসরণের (Urethral Smear) মধ্য দিয়ে এদের যৌনসুখের চরম তৃপ্তি বা অর্গাজম অনুভূত হয়।
হিজড়াদের ভোটাধিকার : হিজড়ারা আগেও ভোট দিত, এখনও দেয়। তবে
হিজড়া হিসাবে ভোট দেওয়া যায় না। যেহেতু এরা নারী-বেশ ধারণ করেন এবং স্ত্রীলিঙ্গে
নাম ধারণ করে সেইহেতু ভোটের সময় এরা স্ত্রী ভোটার হিসাবেই চিহ্নিত হয়। অথচ
রহস্যজনকভাবে এরাই আবার জনগণনায় ‘পুরুষ’ হিসাবে নথিভুক্ত হয়। সর্বভারতীয় হিজড়া কল্যাণ সভার সভাপতি শ্রী
খৈরাতিলাল ভোলা হিজড়াদের ‘হিসাবে’ ভোট দেওয়ার আইনি স্বীকৃতি আদায় করার জন্য ‘Election Commisson of India’-র কাছে আবেদন
জানিয়েছেন।আবেদনে সাড়া দিয়ে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের
সমস্ত মুখ্য নির্বাচনী অফিসারের ভোটার তালিকায় হিজড়াদের ‘হিজড়া’
হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ পাঠান। সমস্যাটা আর-এক জায়গায় –
সমস্ত হিজড়াই নিজেদের ‘স্ত্রীলোক’
হিসাবেই পরিচয় দিতে আগ্রহী। তারা চায় না ভোটার তালিকায় ‘হিজড়া’ হিসাবে নাম থাকুক।
হিজড়াদের সংস্কার : হিজড়া দুনিয়ায় সব সদস্যকেই বেশকিছু
নিয়মনীতি মান্য করে চলতে হয়।যেমন – (১) রাস্তায় অপরিচিত কোনো পুরুষের
সঙ্গে হালকা চালে কথা বলা এবং অশালীন আচরণ হিজড়াসমাজে গর্হিত অপরাধ।(২) সন্ধ্যার
পর হিজড়া মহল্লার সব দরজা বন্ধ হয়ে যায়। অতি পরিচিত কোনো ব্যক্তি ছাড়া ভিতরে
প্রবেশ নিষেধ। অবশ্য ঝুপড়িবাসীদের ক্ষেত্রে এই নিয়ম কার্যকর হবে না (৩) খুব জরুরি
প্রয়োজন ছাড়া বা আমন্ত্রণ না-পেলে কোনো গুরু-মা সাধারণত অপর কোনো গুরু-মায়ের সঙ্গে
দেখা করতে যান না। (৪) কোনো গুরু-মা মাটিতে বসে থাকলে তা চেলা বা শিষ্যরা খাটে বা
উঁচু কোনো জায়গায় বসে না।(৫) কিছু কিছু মহল্লায় হিজড়ারা খুব ভোরে উঠে প্রধান দরজার
চৌকাঠে ঝাঁটা বা লাঠি দিয়ে আঘাত করে। অনেকে আবার মহল্লার মাথায় ছেঁড়া জুতো বেঁধে
রাখে। (৬) হিজড়ারা মনে করে সন্তানসম্ভবা কোনো মহিলার উদর বা পেট যদি কোনো হিজড়া
বিশেষভাবে নিরীক্ষণ করে তাহলে গর্ভস্থ সন্তান হিজড়া হয়ে ভূমিষ্ঠ হবে। (৭) হিজড়ারা
মনে করে হিজড়াদের লেখা চিঠি যদি কোনো গর্ভবতী মহিলা পাঠ বা স্পর্শ করে তাহলে
ভ্রূণের ক্ষতি হবে ইত্যাদি।
হিজড়াদের ঢোল : হিজড়াদের জীবনে ঢোল একটি
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত।বাচ্চা নাচাতে ঢোলের বাজনা অত্যাবশ্যক
অনুসঙ্গ। কর্মক্ষেত্র ছাড়া অকারণে গুরু-মায়ের সামনে ঢোল বাজালে বা হাতের তালি দিলে
শিষ্যদের ক্ষতি হবে বলে বিশ্বাস। হিজড়াদের বিশ্বাস ঢোল পায়ে লাগা পাপ। সকালে,
বিকালে ঢোলকে এরা প্রণাম করে। কোনো-কোনো মহল্লায় কাজের শেষে
ঢোলগুলিকে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে সিঁদুরের ফোঁটা দেওয়া হয়। সকালে কাজে বেরনোর
আগে যদি কোনো অ-হিজড়া ঢোল স্পর্শ করে তাহলে ঢোলটি অপবিত্র হয়ে যায়। সেদিনের জন্য
ওই ঢোল বাতিল, অন্য ঢোল নিয়ে কাজে বেরতে হয়।হাজারো বিপদের
মাঝে নিজে জান দিয়ে হলেও ঢোলকে অক্ষত রাখা হিজড়াদের অসীম কর্তব্য।হিজড়াদের বিশ্বাস,
এই ঢোল যদি অন্য কেউ কেড়ে নেয় তাহলে মনে করা হয় বিপদ
নিকটেই।এছাড়া মহল্লার গুরু-মায়ের সম্মতি ছাড়া ঢোল কেনা গর্হিত অপরাধ। সমস্ত হিজড়া
মহল্লায় ঢোল পুজো হয়। ঢোল পুজো এদের একটি বাৎসরিক উৎসব। কালীপুজোর রাতে এরা ঢোলের
আরাধনায় বসে।এদিন কেউ কাজে বেরন না। নিরামিষ খাবে সবাই। ঢোল পুজোর অনুষ্ঠানে
বাইরের কেউ প্রবেশাধিকার পায় না।পুরোনো চামড়ার ঢোল এই পুজোর বাতিল।যাই হোক,
পুজোয় বসে গুরু-মা। কোনো নির্ধারিত মন্ত্র-টন্ত্র নেই এই
পুজোয়।গুরু-মা চোখ বন্ধ করে ধ্যানে বসে, ধ্যান ভাঙলে পুজো
শেষ।
হিজড়াদের ধর্মবিশ্বাস : জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়নির্বিশেষে
সমস্ত রকমের ভেদাভেদ ভুলে এক সম্প্রীতির সমাজ গড়ে তুলেছে হিজড়া সমাজ।যে-কোনো হিজড়া
মহল্লায় দেখা মিলবে সব ধর্মের হিজড়া। পারস্পরিক সহযোগিতা, সহানুভূতি,
সহমর্মিতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এরা ধর্মীয় সহিষ্ণুতা গড়ে তুলেছে।
ধর্মের ব্যাপারে কোনো বাড়াবাড়ি বা রক্ষণশীলতা এক্কেবারেই নেই। সব ধর্মের
দেব-দেবতাই সকল হিজড়াদের ইষ্টদেবতা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন