প্রাচীন গ্রিসের সংস্কৃতিতে প্রথম প্রাপ্তবয়স্ক
পুরুষদের মধ্যে গভীর প্রণয় সম্পর্কের উল্লেখ পাওয়া যায় “ইলিয়াড” মহাকাব্যে। হোমার অ্যাকিলিস ও প্যাট্রোক্ল্যাসের সম্পর্কটিকে যৌন
সম্পর্ক বলেননি। চিত্রকলা ও পাত্রচিত্রে প্যাট্রোক্লাসের দাড়ি আঁকা হত। অপরদিকে
গ্রিক সমাজে অ্যাকিলিসের স্থান দেবতুল্য হলেও তাঁর চিত্র উলঙ্গই আঁকা হত। এর ফলে
কে "এরাস্টেস" এবং কে "এরোমেনোস" ছিলেন, তাই নিয়ে মতানৈক্য দেখা যায়। হোমারীয় ঐতিহ্যে প্যাট্রোক্ল্যাস ছিলেন
বয়সে বড়ো; কিন্তু অ্যাকিলিস ছিলেন বেশি শক্তিশালী।
অন্যান্য প্রাচীন গল্পের মতে, অ্যাকিলিস ও
প্যাট্রোক্ল্যাস ছিলেন নিছক বন্ধু। ঐতিহাসিক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ প্রণয়ীযুগলের
মধ্যে এথেন্সের পাউসানিয়াস ও ট্র্যাজিক কবি আগাথন বিখ্যাত। আগাথনের বয়স ছিল
ত্রিশের বেশি। মহামতি আলেকজান্ডার ও তাঁর বাল্যবন্ধু হেফাস্টনের সম্পর্কও একই
ধরনের ছিল বলে মনে করা হয়।
স্যাফো নারী ও বালিকাদের উদ্দেশ্য করে অনেকগুলি কবিতা
রচনা করেছিলেন। ইনি লেসবোস দ্বীপের বাসিন্দা। স্যাফো সম্ভবত ১২,০০০ লাইনের কবিতা
লিখেছিলেন নারীদের জন্য। তবে তার মধ্যে মাত্র ৬০০ লাইনরই সন্ধান পেলে। তাই স্যাফো
প্রাচীনকালের নারী-সমকামী কবি হিসাবে পরিচিত। তিনি গ্রিক সমাজে
"থিয়াসোস" বা অল্পশিক্ষিতা নারী হিসাবে পরিচিত ছিলেন। সেযুগের সমাজে
নারীজাতির মধ্যেও সমকামিতার প্রচলন ছিল। নগররাষ্ট্রের উদ্ভবের পর বিবাহপ্রথা সমাজ
ও সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে ওঠে এবং মেয়েরা গৃহবন্দী হয়ে পড়ে।
"থিয়াসোস"-রা হারিয়ে যায়। স্যাফোর জন্মস্থান লেসবস থেকেই তো অভিধানে
জায়গা পেয়েছে লেসবিয়ান শব্দটি। সামাজিকভাবে নারীর সমকামিতার কোনো স্থান হয়নি।
সাধারণ ভাবে নারীর সমকামিতার ঐতিহাসিক প্রামাণ্য তথ্য বেশি নেই।
সমকামী বিষয়বস্তু সম্পর্কে দীর্ঘকাল নীরব থাকার পর
ঐতিহাসিকরা এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করেন। এরিক বেথে ১৯০৭ সালে এ বিষয়ে আলোচনা শুরু
করেছিলেন। পরে কে. জি. ডোভারাও গবেষণা চালিয়ে যান। গবেষণায় জানা গেছে, প্রাচীন গ্রিসে
সমকামিতার খোলাখুলি প্রচলন ছিল। এমনকি সরকারি অনুমোদনও ছিল। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম
শতাব্দী থেকে রোমান যুগ পর্যন্ত এই অবস্থা চলেছিল। কোনো কোনো গবেষকদের মতে সমকামী
সম্পর্ক, বিশেষত পেডেরাস্টির প্রচলন ছিল উচ্চবিত্ত সমাজের
মধ্যেই। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই প্রথার প্রচলন খুব একটা ছিল না। ব্রুস থর্নটনের
মতে, অ্যারিস্টোফেনিসের কৌতুক নাটকগুলিতে গ্রহীতার স্থান
গ্রহণকারী সমকামীদের প্রতি উপহাস করার প্রবণতা থেকে বোঝা যায়, পুরুষ সমকামিতাকে সাধারণ মানুষ ভালো চোখে দেখত না। ভিক্টোরিয়া ওল
প্রমুখ অন্যান্য ঐতিহাসিকেরা বলেছেন, এথেন্সে সমকামী
সম্পর্ক ছিল "গণতন্ত্রের যৌন আদর্শ"। এটি উচবিত্ত ও সাধারণ মানুষ --
উভয় সমাজেই সমাজভাবে প্রচলিত ছিল। হার্মোডিয়াস ও অ্যারিস্টোগেইটন নামে দুই
হত্যাকারীর ঘটনা থেকে তা প্রমাণিত হয়। এমনকি যাঁরা বলেন যে, পেডেরাস্টি উচ্চবিত্ত সমাজেই সীমাবদ্ধ ছিল, তাঁরাও
মনে করেন যে এটি ছিল "নগররাষ্ট্রের সামাজিক কাঠামোর অঙ্গ"।
আধুনিক গ্রিসে এই বিষয়ে বিতর্ক হয়েছে। ২০০২ সালে
মহামতি আলেকজান্ডার সম্পর্কিত এক সম্মেলনে তাঁর সমকামিতা নিয়ে বিতর্ক হয়। ২০০৪
সালে মুক্তিপ্রাপ্ত “আলেকজান্ডার” চলচ্চিত্রে আলেকজান্ডারকে উভকামী
হিসাবে দেখানোর জন্য ২৫ জন গ্রিক আইনজীবী চলচ্চিত্রের নির্মাতাদের বিরুদ্ধে মামলা
করার হুমকি দিয়েছিলেন। তবে ছবির এক আগাম প্রদর্শনীর পর তাঁরা আর মামলা করেননি।
দীপা মেহতার ‘ফায়ার’ বা
মধুর ভাণ্ডারকারের ‘পেজ থ্রি’ ছাড়াও
সমকালে ভারতীয় সিনেমাতে সমলিঙ্গ প্রেমের প্রচুর উদাহরণ আছে। সদ্যপ্রয়াত ঋতুপর্ণ
ঘোষের ‘চিত্রাঙ্গদা’, কিংবা ‘তিনকন্যা’, মৈনাকের ‘ফ্যামিলি
অ্যালবাম’, অপর্ণা সেনের ‘পারমিতার
একদিন’ ‘তাসের দেশ’-এর মতো হাল
আমলের নানা বাংলা ছবির গল্পও ঘিরেছে সমকামী সম্পর্ক। লক্ষ করা গেছে আদিকাল থেকে
শিল্প-সাহিত্যেও মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত অভিলাষ সমকামিতার প্রতিফলন। অথচ ভারতসহ
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আদালতের রায়ে সহস্রাব্দ প্রাচীন সমকাম আজ বিকৃত সমকামিতা
অপরাধ। গ্রিক সভ্যতা থেকে প্রাচীন ভারত। আধুনিক সাহিত্য-সিনেমাতেও বারবার জায়গা
করে নিয়েছে সমকামী মানুষের গল্প। প্রাচীন নাগরিক সমাজ, ব্যক্তির
স্বাধীনতা, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণা যেখানে জন্ম
নিয়েছিল গ্রিসে। সেই গ্রিস, যে কখনও নাগরিকের যৌন
স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেনি। সমলিঙ্গ যৌন সংসর্গের বৈধতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছিল
না সেখানে। হেরোডেটাস, প্লেটোর মতো দার্শনিক-চিন্তাবিদদের
লেখায় প্রায়ই পাওয়া যায় সমকামী সম্পর্কের কথা।
ইতিহাস বলছে, প্রাচীন পারস্যে সমকামী সম্পর্কের
প্রচলন ছিল। এই ভারতবর্ষেও সমকামিতা ছিল এবং আছে। বহু হিন্দু মন্দিরের দেওয়ালের
ভাস্কর্য তো সমকামেরই পরিচয় প্রকট হয়ে আছে। খাজুরাহোর শিল্পকীর্তিতে তো রয়েছে
গ্রুপ সেক্সের নিদর্শনও। মহাভারতে বৃহন্নলা আর শিখণ্ডি, পুরাণে
বিষ্ণুর মোহিনী রূপ আর অর্ধনারীশ্বর শিব, পুরাণের পাতায়
পাতায় যেন তৃতীয় লিঙ্গের সদর্প উপস্থিতি। এমনকী, বাৎসায়নের
কামসূত্রও সমকামিতা নিয়ে আলোচিত হয়েছে, দেখানো হয়েছে যৌন
সম্পর্কেরই অন্য এক রূপ। এমনকি আধুনিক সাহিত্যেও অনেক লেখক স্বীকৃতি দিয়েছে
সমকামিতাকে । অস্কার ওয়াইল্ডের জীবনী লিখতে গিয়ে প্রখ্যাত এই সমকামী সাহিত্যিকের
জীবনের নানা দিক তুলে ধরেছেন রিচার্ড এলম্যান।
সমকামীদের বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেক ভুলভাল ধারণা
আছে। যেমন – (১) সমকামিতা পাশ্চাত্যের সৃষ্টি। পাশ্চাত্যের উদার সমাজব্যবস্থা এবং
ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সমকামিতার জন্য দায়ী। (২) সমকামিতা এক ধরনের মানসিক বিকৃতি বা
অসুস্থতা। (৩) সমকামীদের সুশিক্ষা এবং চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে
আনা সম্ভব। (৪) সমকামিতা একটা রোগ। (৫) প্রকৃতিতে অন্য কোনো জীবজন্তু বা গাছপালার
মধ্যে সমকামিতা দেখা যায় না। (৬) সমকামীদের সামাজিকভাবে বয়কট করা উচিত। (৭)
জীবজন্তুরা তো অনেক কিছু করে, তাই বলে সেগুলি মানুষেরও
করতে হবে নাকি?
উত্তরে বলি -- প্রথমত, সমকামিতা মোটেই পাশ্চাত্যের সৃষ্টি
নয়। প্রথমত আদিমকাল থেকেই সমকামিতা আছে। ইতিহাসের বিভিন্ন অংশে সমকামিতার
দৃষ্টান্ত আছে। সমকামিতা কোনো ফ্যাশান নয়, এটি একটি
যৌন-সংকট। প্রাচীন বিভিন্ন মহাকাব্য সমকামিতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আছে।
মধ্যপ্রাচ্যে সমকামিতার ব্যাপক প্রচলন ছিল এক সময়ে। আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট,
সক্রেটিস সমকামী ছিলেন। কামসুত্রে সমকামিতার প্রচুর উদাহরণ আছে।
অতএব সমকাম কোনো পাশ্চাত্যের তৈরি করা বিষয় নয়। দ্বিতীয়ত প্রাণীকুলে সমকামিতার
ব্যাপক বিস্তার দেখতে পাওয়া যায়। প্রাণীকুল পাশ্চাত্যের উদার জীবনব্যবস্থা থেকে
শিক্ষা নিয়েছে এটা যারা ভাবে তাদের সম্পর্কে বলার কিছু নেই।
দ্বিতীয়ত, সমকামিতা কোনোভাবেই মানসিক বিকৃতি
নয়। কিন্তু জীববিজ্ঞানী এবং মনোবিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন যে, সমকাম কোনো মানসিক বিকার নয়। এটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক প্রাকৃতিক বিষয়।
প্রত্যেক জীবের মধ্যে কিছু অংশ অবশ্যই সমকামী হয়ে জন্ম নেবে। তারা বেড়ে ঊঠবে
সমকামী হয়ে, তাদের চালচলনে সমকামী ভাব ফুটে ঊঠবে। একটা
রক্ষণশীল সমাজে সমকামীরা বেঁচে থাকে গোপনে, তাদের
যৌনপ্রবৃত্তি তারা উপভোগ করে গোপনে, অনেক ক্ষেত্রে
অপরাদের মাধ্যমে, আর-একটা মুক্তসমাজে সেটা হয় প্রকাশ্যে।
প্রকাশ্যে হওয়ার কারণে অপরাধের মাত্রা কমে যায়। মাদ্রাসার শিক্ষকরা বা ইমামরা যারা
সমকামী, তাঁরা তাঁদের যৌন আকাঙ্ক্ষা মেটায় অপরাধের মাধ্যমে।
হয়তো তারা একজন নারীর সঙ্গে বিবাহত জীবন পালন করছে, কিন্তু
তৃপ্তির অভাবে তারা প্রতিনিয়ত সুযোগ খোঁজে তাদের অবদমিত কামনা পুরণের। যার শিকার
সব সময় আমাদের দেশের বালক-তরুণরা হয়। কিন্তু উন্নত বিশ্বে সমকামীরা প্রকাশ্যে বলে
যে তারা সমকামী। যার ফলে চিনতে পারা সহজ হয় এবং সমলিঙ্গের Straight মানুষরা সবসময় সতর্ক থাকতে পারে। তার উপর সমকামীরা সমকামী সঙ্গী বেছে নিয়ে স্বাভাবিক বিবাহিত এবং যৌন জীবনযাপন করলে তারা অপরাধের মাধ্যমে তাদের যৌনাকাঙ্ক্ষা পূরণ করার প্রয়োজন পড়ে না।
তৃতীয়ত, সমকামীদের নিয়ে যেই মামলাগুলি হয়েছে, সেখানে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা দাবি করেছিল যে সমকামীরা বিকৃতির শিকার কিংবা রোগী বা কিংবা অসুস্থ। কিন্তু মেডিকেল সায়েন্সে straight-দের সঙ্গে সমকামীদের কোনো পার্থক্য আছে, শারীরিক বা মানসিকভাবে, তার কোনো প্রমাণ নেই। তাহলে সমকামীরা অসুস্থ বা মানসিক বিকৃতির শিকার বা বিকলাঙ্গ তাও বলা যাচ্ছে না।
চতুর্থত, প্রকৃতিতে বিভিন্নভাবে কীভাবে
সমকামিতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। প্রকৃতির সৃষ্ট প্রায় প্রতিটি প্রাণী এবং বৃক্ষরাজিতে
সমকামিতা বিদ্যমান। বেশিরভাগ জীব এবং গাছপালায় সমকামিতার প্রকাশ আছে।
ষষ্ঠত, সমকামীদের কেন সামাজিকভাবে বয়কট করার কথা বলা হবে ?
তারা রক্তমাংসের মানুষ। একজন সমকামী পুরুষের নারীর প্রতি
প্রাকৃতিকভাবে আকর্ষণ বোধ করে না। কোনো নগ্ন বা অর্ধনগ্ন নারী দেখলে তার লিঙ্গ
উত্থিত হয় না। সেই পুরুষের লিঙ্গ উত্থিত হবে কোনো নগ্ন বা অর্ধ নগ্ন পুরুষ দেখলে।
একইভাবে নারী সমকামীরও কোনো নগ্ন নারী দেখলে উত্তেজনা আসবে, অপরদিকে পুরুষদের দেখে তাকে যৌনসঙ্গী করার কোনো ইচ্ছাই জাগবে না। এই
কারণে নিশ্চয়ই একজন মানুষকে একঘরে করে রাখা বা বয়কট করা কোনোমতেই মানবিক আচরণ হতে
পারে না। এটা অন্যায্য, ব্যক্তি-স্বাধীনতায় নির্লজ্জ
হস্তক্ষেপ।
সপ্তমত, জীবজন্তুরা এমন অনেক কাজ করে যেটা সভ্য মানুষের করা
উচিত নয়, এটা ঠিক । যেমন ধর্ষণ প্রবৃত্তি জীবকুলে
বিদ্যমান, পিতামাতার সঙ্গে যৌনতা প্রাণীকুলে বিদ্যমান।
একজন সভ্য মানুষ কখনোই এই ধরনের কাজ করতে বা সমর্থন করতে পারে না। কথা হচ্ছে
সমকামিতাও কি একই ধরনের ব্যাপার ?
সমকামিতা সমকামীরা নিজে নির্ধারণ করে না। প্রকৃতি তাদের
ভিতরে সমকামিতার বীজ বপন করে। একজন ধর্ষক ধর্ষণ না-করেও সুস্থ্ যৌনতার মাধ্যমে
নিজের যৌনাকাঙ্ক্ষা পুরণ করতে পারে। একজন ইনসেস্টার বা অজাচারিতা ইনসেস্ট বা
অজাচার সম্পর্ক না-করেও সুস্থ যৌনজ়ীবন যাপন করতে পারে।
হিজড়ে এবং সমকামীরা কি একই সমগোত্রীয় ? সোমনাথ
বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘অন্তহীন অন্তরীণ প্রোষিতভর্তৃকা’
গ্রন্থে বিষয়টা পরিষ্কার করেছেন। তিনি হিজরানী শ্যামলী-মায়ের মুখ
দিয়ে বলিয়েছেন – “এতদিনে মানুষের ধারণা ছিল হিজড়ে বুঝি
জন্ম থেকেই হয়। ছোটোবেলাতেই হিজড়ে সন্তান জন্মালে মা-বাবা তাকে হিজড়ে ডেরায় দিয়ে
আসে। কেন – এমন গল্প শুনিসনি, হিজড়ে
বাচ্ছাকে মা-বাবা আটকে রেখেছিল, পাড়ায় হিজড়েরা তালি
দিচ্ছিল, আর সেই তালি শুনে ঘর থেকে বাচ্ছা হিজড়ে তালি
দিল। আর সেই তালি শুনে হিজড়েরা বাচ্ছাটাকে নিজেদের সঙ্গে নিয়ে চলে গেল !”
হিজড়া হতে হলে লিকম্ (লিঙ্গ) ছিবড়াতে (কর্তন) হয়।অণ্ডকোশ
সমেত পুরুষাঙ্গ কেটে ফেললে তবেই ‘নির্বাণ’ বা প্রকৃত সন্মানিত
হিজড়া হওয়া যায়।অবশ্য পুরুষাঙ্গ কর্তন করতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
পুরুষাঙ্গ নিয়ে যে ধুরানি (বেশ্যা বা যৌনকর্মী) হিজড়া বৃত্তি করবে তাকে হিজড়ারা ‘আকুয়া’ (বিপরীত সাজসজ্জাকামী ও
যৌনপরিবর্তনকামী) বলে।
ওরা ঢোল বাজিয়ের দল, ওরা হিজড়া। ওরা নবজাতকের খোঁজে বাড়ি
বাড়ি ঘুরে বেড়ায়, ওরা হিজড়া। ওরা এক শ্রেণির অবাঞ্ছিত
অপাঙক্তেয় মানবগোষ্ঠী, ওরা হিজড়া। ওরা যৌন বিকলাঙ্গ –
এক প্রতিবন্ধী মানুষ, ওরা হিজড়া। মনুষ্য
সমাজে এক অন্তঃসলিলা প্রবাহ, যাঁরা প্রাগৈতিহাসিক যুগ
থেকে চলে আসছে সমাজের উত্থানপতন ও বিবর্তনের মধ্য দিয়ে, ওরা হিজড়াই। প্রাণীজগতে আমরা চার প্রকারের উভলিঙ্গত্ব দেখতে পাই। (১) প্রকৃত হিজড়া (True Hermaphrolite), (২) পুরুষ অপ্রকৃত হিজড়া (Male Pseudo Hermaphrodite), (৩) স্ত্রী অপ্রকৃত হিজড়া (Female Pseudo Hermaphrodite) এবং (৪) ফ্রিমার্টিন সিনড্রোম (Freemartin Syndrome)।প্রকৃত হিজড়াদের ক্ষেত্রে একই দেহে শুক্রাশয় ও ডিম্বাশয়ের অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। পুরুষ অপ্রকৃত হিজড়াদের শরীরের আপাত বাহ্যিক গঠন মেয়েলি হলেও শুক্রাশয় বর্তমান। স্ত্রী অপ্রকৃত হিজড়াদের দৈহিক গঠনের সঙ্গে সুস্থ পুরুষের আপাত সাদৃশ্য থাকলেও এরকম হিজড়ার দেহে ডিম্বাশয় থাকে।
হিজড়াদের মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা যায় – (১) জন্মগত হিজড়ে
এবং (২) ছদ্মবেশী হিজড়া।
(১) জন্মগত হিজড়ে : আমরা আমাদের চারপাশে যেসব হিজড়া দেখি
তাদের অনেকেই জন্মগত যৌন প্রতিবন্ধী। এদের যৌন জনন বৈকল্য বা প্রতিবন্ধকতা একরকম
নয়। কারোর যৌনাঙ্গ অপুষ্ট বা অপূর্ণাঙ্গ। কারোর-বা শরীরে নারী ও পুরুষ অপরিপূর্ণ
যৌনাঙ্গের অবস্থান লক্ষ করা যায়। এখন প্রশ্ন কেন প্রতিবন্ধকতা ?
নারী-পুরুষ লিঙ্গ নির্ধারণ হয় দুই ধরনের আলাদা আলাদা ক্রোমোজোমের উপস্থিতিতে। সাধারণত প্রতি কোশে এক জোড়া ক্রোমোজোম দেখা যায়, যারা বস্তুত লিঙ্গ নির্ধারক। এই ক্রোমোজোমগুলিই হল Sex Chromosome বা যৌন ক্রোমোজোম। যৌন ক্রোমোজোম দুটিকে X এবং Y দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। বাকি ক্রোমোজোমগুলি জীবের অন্যান্য বৈশিষ্ঠ্যের ধারক। এরা Autosome বা অযৌন ক্রোমোজোম।স্বাভাবিক ক্ষেত্রে মানুষের দেহকোশের ক্রোমোজোমের সংখ্যা ৪৬ বা ২৩ জোড়া। এই ২৩ জোড়া ক্রোমোজোমের মধ্যে এক জোড়া ক্রোমোজোম নির্ধারক। অর্থাৎ বাকি ২২ জোড়া অটোজোম।Y ক্রোমোজোমের আকৃতি ও আয়তনে X ক্রোমোজোমের তুলনায় ক্ষুদ্র। স্ত্রী দেহকোশে দুটি X ক্রোমোজোম থাকে। অপরদিকে, পুরুষ দেহকোশে একটি X এবং একটি Y ক্রোমোজোম থাকে। প্রতিটি কন্যা সন্তান মাতাপিতার কাছ থেকে ২২ জোড়া অযৌন ক্রোমোজোম পেয়ে থাকে। এর ম্যধ্যে মায়ের কাছ থেকে একটি X ক্রমোজোম এবং বাবার কাছ থেকে একটি Y ক্রোমোজোম, অর্থাৎ দুটি XX যৌন ক্রোমোজোম পেয়ে থাকে। অপরদিকে পুত্র সন্তানটি ২২ জোড়া অযৌন ক্রোমোজোমের সঙ্গে মায়ের কাছ থেকে একটি X এবং বাবার কাছ থেকে একটি Y ক্রোমোজোম লাভ করে।এটাই স্বাভাবিক হলেও সবসময় তা হয় না। অনেক সময় যৌন ক্রোমোজোমের ত্রুটির ফলে কোনো সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। অর্থাৎ সন্তানটি ছেলে না মেয়ে, সেটা বলা নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। তখন সে তৃতীয় সেক্সের দলে পড়ে, অর্থাৎ হিজড়া।
ক্রোমোজোম ও বার্বডির ত্রুটির হিসাবে হিজড়াদের ছয় ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-- (১) ক্লাইনেফেলটার সিনড্রোম, (২) XXY পুরুষ, (৩) XX পুরুষ, (৪) টার্নার সিনড্রোম, (৫) মিশ্র যৌনগ্রন্থির বিকৃতি।
(১) ক্লাইনেফেলটার সিনড্রোম (Klinefelter Syndrome): এদের স্ফীত স্তন দেখা যায়। এদের শিশ্ন বা পুংলিঙ্গ থাকে বটে, তবে তা অত্যন্ত ক্ষুদ্র। শুক্রাশয়ও খুব ছোটো হয়। বগল (বাহুমূল) চুল বা কেশ থাকে না। এদের তলপেটের নীচে, অর্থাৎ যৌনাঙ্গের চারপাশে চুল কম হয়। মুখে দাড়ি-গোঁফ কম হয়। এরা সাধারণত উচ্চতায় লম্বা ধরনের হয়ে থাকে। মানসিক জড়তাও থাকতে পারে।এই সমস্ত ব্যক্তিদের দেহকোশে ২২ জোড়া অটোজোম, ২টি X ক্রোমোজোম এবং একটি Y ক্রোমোজোম -- মোট ৪৭টি ক্রোমোজোম থাকে। সাধারণ অবস্থায় পুরুষের শরীরে যৌন ক্রোমোজোম থাকে XY এবং মোট ক্রোমোজোমের সংখ্যা হয় ৪৬টি। অতিরিক্ত স্ত্রী যৌন ক্রোমোজোম, অর্থাৎ X-এর উপস্থিতির ফলেই ব্যক্তির শরীরে স্ত্রী-বৈশিষ্ট্য প্রকট হয়।
(২) XXY পুরুষ (XXY Male) : এদের শরীরের গঠন পুরুষদের মতো হলেও এরা পুরোপুরি পুরুষ নয়।এরা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি লম্বা হয়। এদের বুদ্ধিবৃত্তি কম। এদের মধ্যে অনেক সময়েই হিংসাত্মক সমাজবিরোধী আচরণের প্রকাশ ঘটে।পুরুষদের মতো লিঙ্গ থাকে।তবে লিঙ্গ থাকলেও মূত্রছিদ্রটি লিঙ্গের স্বাভাবিক স্থানে না। এদের অণ্ডকোশও স্বাভাবিক স্থানে না। থাকে শরীরের অভ্যন্তরে।এদের শরীরে ক্রোমোজোমের সংখ্যা ৪৭।৪৪ টি অটোজোম এবং ৩ টি যৌন ক্রোমোজোম। যৌন ক্রোমোজোমের মধ্যে একটি X এবং দুটি Y ক্রোমোজোম থাকে।
(৩) XX পুরুষ (XX Male Syndrome) : XX-পুরুষদের সঙ্গে ক্লাইনেফেলটার সিনড্রোমের অনেক মিল আছে। এদের অনেকেরই স্তন থাকে। তবে তা কখনোই সুডৌল এবং স্ফীত নয়।শুক্রাশয় থাকে, তবে তা খুবই ক্ষুদ্র। তবে শুক্রাশয় থাকলেও সেখানে শুক্রাণু উৎপন্ন হয় না।পুরুষাঙ্গ আকৃতিতে স্বাভাবিক, অথবা স্বাভাবিকের তুলনায় ছোটোও হতে পারে। লিঙ্গের যে স্থানে মূত্রছিদ্রটি থাকার কথা সেখানে থাকে না। XX-পুরুষরা উচ্চতায় বেঁটে প্রকৃতির হয়।এই ধরনের XX-পুরুষের শরীরে ক্রোমোজোমের মোট সংখ্যা ৪৮। অটোজোম ৪৬ টি এবং দুটি সেক্স ক্রোমোজোম থাকে। XX সেক্স ক্রোমোজোমের উপস্থিতি থাকলেও ক্রোমোজোমের গঠনের অস্বাভাবিকতার জন্য এরা পরিপূর্ণ নারী হয়ে উঠতে পারে না।বিভিন্ন রকম পুরুষালি ভাব প্রকট হয়।
(৪) টার্নার সিনড্রোম (Turner Syndrome) : এদের ক্রোমোজোমের গঠন ক্লাইনেফেলটার সিনড্রোম ও XX-পুরুষ হিজড়াদের অনুরূপ নয়। আপাতদৃষ্টিতে এদের নারী মনে হলেও এরা কিন্তু পুরোপুরি নারী নন। কারণ এদের প্রধান যৌনাঙ্গ এবং অন্যান্য গৌণ যৌনাঙ্গ ত্রুটিযুক্ত। এদের যৌনাঙ্গের সঙ্গে নারীর যৌনাঙ্গের আপাত সাদৃশ্য থাকে। যোনিকেশ খুবই কম দেখা যায়। ডিম্বাশয় থাকে না এবং অপূর্ণাঙ্গ ফেলোপিয়ান টিউব ও জরায়ুর গঠন। এর ফলে রজঃস্বলা বা পিরিয়ড হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এদের বুকের ছাতি পুরুষদের মতো প্রশস্ত। তবে এদের প্রশস্ত ছাতিতে কৈশোর থেকে স্তনগ্রন্থির প্রকাশ ঘটে। এরা অস্বাভাবিক খর্বাকৃতি হয়। গায়ের চামড়া টানলে অনেকটা ঝুলে পড়ে। হাত-পায়ের অত্যন্ত খসখসে হয়।এদের বৌদ্ধিক ক্ষমতা সাধারণের চাইতে কম।এদের কোশের ক্রোমোজোমের সংখ্যা ৪৫ (অটোজোম ৪৪ + X)। বার্বোডি থাকে না। ক্রোমোজোমের এই অস্বাভাবিকতার জন্যেই এদের যৌনাঙ্গ ইত্যাদি ত্রুটিযুক্ত হয়। Y ক্রোমোজোমের অনুপস্থিতি যেমন শরীরে পুরুষালি ভাব প্রকাশের অন্তরায় হয়ে শরীরকে নারীসুলভ করে তোলে, ঠিক তেমনই বার্বোডি না-থাকায় নারী শরীরের স্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ ঘটে না। দেহের গঠন আংশিক পুরুষের মতো হয়ে থাকে।
(৫) মিশ্র যৌনগ্রন্থির বিকৃতি (Mixed Gonadal Dysgenesis) : আপাতদৃষ্টিতে এদের পুরুষ বলেই মনে হয়। গোঁফ-দাড়িও হয়। শুক্রাশয় থাকে, তবে তা থাকে শরীরের অভ্যন্তরে। এই প্রকার হিজড়াদের শুক্রাশয়ের বিভিন্ন প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্যই পরিণত শুক্রাণুর জন্ম হয় না। এদের শিশ্ন বা লিঙ্গ বর্তমান থাকে। মূত্রছিদ্র লিঙ্গের স্বাভাবিক স্থানেই থাকে।ব্যতিক্রম যেটা, সেটা হল লিঙ্গ থাকা সত্ত্বেও এদের শরীরে যোনি অর্থাৎ স্ত্রীযোনি, জরায়ু এবং ফেলোপিয়ান টিউব থাকে। কৈশোরের এদের শুক্রাশয় থেকে এন্ড্রোজেন নিঃসৃত হয়, ফলে শরীরে পুরুষালি ভাব বেশ প্রকট হয়ে ওঠে।প্রধানত ক্রোমোজোমের অস্বাভাবিকতা, অ্যাড্রিনাল গ্ল্যান্ডের নানারকম ত্রুটি এবং জননকোশের উৎপত্তি স্থানের নানা সূক্ষ্ম জটিলতার ফলেই এমন যৌনবিকলাঙ্গ মানুষের জন্ম হয়। এইসব মানুষদের দেহকোশে ক্রোমোজোমের সংখ্যা সাধারণত ৪৬ (৪৫ + X) হয়। অবশ্য অনেক সময়েই ৪৭ (৪৫ + XY)ও দেখা যায়।
হিজড়াদের দলে জন্মগত যৌন-প্রতিবন্ধীর সংখ্যা খুবই নগণ্য।
সামান্য কিছু ব্যতীত প্রায় সকলেই ছদ্মবেশী হিজড়া।তবে শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে
এরা এত বেশি অসুস্থ যে খোশমেজাজে নেচে-গেয়ে হিজড়াদের দলে থেকে এদের জীবন াটিয়ে
দেওয়া সম্ভব নয়। নানাবিধ শারীরিক পীড়ায় জর্জরিত এরা।আর পাঁচটা অসুস্থ-পঙ্গু
মানুষের মতো এরা সংসারের বোঝা। তাই সম্প্রদায়ভুক্ত হিজড়াদের দলে এদের ঠাঁই হয় না।
এদের কাছেও এরা ঝঞ্ঝাট। অন্যভাবে বললে এরা “অপ্রকৃত হিজড়া”।প্রসঙ্গত জানাই, যৌন-প্রতিবন্ধী যাঁরা
তাঁদেরকে “প্রকৃত হিজড়া” বলা
হয়।প্রকৃত হিজড়াদের সকলকেই পুরোপুরি সারিয়ে তোলা সম্ভব না-হলেও চিকিৎসা বিজ্ঞানের
কল্যানে অনেকেই ত্রুটিমু্ক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে।যদিও ক্রোমোজোমের
অস্বাভাবিকতা থাকলে তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনা যায় না ঠিকই, কি্তু হাইপোস্পিডিয়াস থাকলে তাকে সার্জারির সাহায্যে ভালো করে তোলা
সম্ভব হয়। টানার্স সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও অস্ত্রোপচার সম্ভব
হচ্ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির ফলে আগামীদিনে জন্মগত হিজড়ে অনেক কমে যাবে।
(২) ছদ্মবেশী হিজড়া : ছদ্মবেশী হিজড়াদের চারভাগে ভাগ করলে
আলোচনার সুবিধা হবে। যেমন – (ক) আকুয়া, (খ) জেনানা, (গ) ছিবড়ি এবং (ঘ) ছিন্নি।
(ক) আকুয়া : হিজড়া দলে এক ধরনের পুরুষ থাকে যাঁরা মেয়ে সাজতে চায়, মেয়ে হতে চায়।মেয়ে
হিসাবে নিজেকে জাহির করার মধ্যে এঁরা অসম্ভব রকম মানসিক পরিতৃপ্তি বোধ করে।এঁরা
পুরুষ হলেও নারী-বেশ ধারণ করতে পছন্দ করে। স্রেফ এক বিশেষ মানসিক তাড়নায় এরা মেয়ে
সেজে থাকতে চায়। সদ্য শৈশব পেরিয়ে আসা কিশোরদের মধ্যে এরকম ভাব লক্ষ করা যায়। তবে
পরিণত বয়সেও কোনো পুরুষের মধ্যেও এ ধরনের মানসিকতা সৃষ্টি হতে পারে।মনোবিজ্ঞানের
ভাষায় এদের মানসিকতাকে Transexualism বা
লিঙ্গরূপান্তরকামিতা বা যৌন পরিবর্তনকামিতা বলে।নিজেকে পুরোপুরি পালটে মহিলা
হিসাবে পরিচিত হতে চায়।যৌন পরিবর্তনকামী মানুষরা নারীত্বের স্বাদ পেতে চায়।
পুরুষদের এরা প্রেমিকা ভাবে।কৃষ্ণনগর উইমেন্স কলেজের সদ্য নিযুক্ত মানবী
বন্দ্যোপাধ্যায় কিছুদিন আগে পর্যন্তও ‘আকুয়া’ সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় হিসাবে পরিচিত ছিলেন। আজ বিজ্ঞানের কল্যানে ‘পুরুষ’ সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে ‘নারী’ হিসাবে মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়ের
পুনর্জন্ম হয়েছে।
এই আকুয়ারা সমবয়সিকে স্রেফ বন্ধু হিসাবে পেতে চায়, যৌনসঙ্গী হিসাবে
নয়।কিন্তু পুরুষ হয়েও মেয়েলি স্বভাব ও আচরণের জন্য মেয়েরা তাঁদের মেয়ে হিসাবে মেনে
নিতে পারে না। মেয়েলি ভাবের জন্য এরা যেমন মেয়েদের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়,
তেমনি পুরুষদের কাছ থেকেও প্রত্যাখ্যাত হয়।ফলে এদের ম্যে
বিচ্ছিন্নতাবোধ ও অন্তর্মুখীনতা দেখা যায়। দারিদ্র্য, সাংসারিক
আর পারিপার্শ্বিক চাপে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠা আকুয়ারা একটা সময় হিজড়াদের দলে এসে ভিড়ে
যায়। সবার ভাগ্যে তো আর মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো ঘর ও বর জোটে না !
(খ) জেনানা : জেনানা হল নারীর সাজে সজ্জিত কোনো পুরুষ। তবে এদের
আকুয়া বলা যাবে না। কারণ জেনানারা কোনো বিশেষ মানসিকতার দ্বারা আক্রান্ত নয়। নারী
বেশ ধারণের মধ্য দিয়ে এরা কোনো সুখ উপলব্ধি করে না। যৌন-প্রতিবন্ধী হিসাবে পরিচিত
হয়ে এরা সমাজের কাছ থেকে সর্বপ্রকার বাড়তি সুযোগ-সুবিধা আদায় করতে চায়। কম খেটে
অসদুপায়ে বেশি রোজগারের আশায় জেনানা হিজড়াদের এই ধরনের নারীবেশ ধারণ। হিজড়ার জগতে
জেনানাদের দাপটই সবচেয়ে জেনানারা আবার দু-ধরনের হয়। যেমন – (অ) যৌনক্ষমতাহীন
জেনানা এবং (আ) যৌনক্ষমতাসম্পন্ন জেনানা।
(অ) যৌনক্ষমতাহীন জেনানা : হিজড়া দলের এইসব জেনানারা অর্থনৈতিক
দিক দিয়ে সমাজের এক্কেবারে পিছিয়ে-পড়া শ্রেণির মানুষ। অস্বাস্হ্যকর ঝুপড়ি-বস্তি
এলাকা থেকেই এইসব হিজড়ারা সংগৃহীত হয়। এদের কেউ কেউ অনাথ। এরা স্বেচ্ছায় হিজড়াদের
দলে চলে আসে। দারিদ্র্য, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা এবং অল্প পরিশ্রমে রোজগারের হাতছানি যৌনক্ষমতাহীন
ব্যক্তিদের হিজড়াদের ডেরায় ভিড়ে যায়।
(আ) যৌনক্ষমতাসম্পন্ন জেনানা : এরা শরীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে
পরিপূর্ণ সুস্থ পুরুষমানুষ। এরা ধান্দাবাজ, ধুরন্ধর। এদের অনেকেরই
স্ত্রী-সন্তান-পরিবার থাকে। কোনো জেনানা যদি হিজড়েদের দলের প্রধান হয় তাহলে তার
পক্ষে তার পরিবারের সঙ্গে থাকা সম্ভব হয় না। দল পরিচালনার জন্যে তাকে
হিজড়া-মহল্লাতেই থাকতে হয়। তাই বলে পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্ক নষ্ট হয় না। সেই
কারণেই এদেরকে রোজ ভোর হতে না-হতেই ছুটতে হয় হিজড়েদের দুনিয়াতে।
(গ) ছিবড়ি : শুধু পুরুষরাই নয়, হিজড়াদের দলে কিছু মহিলাদেরও দেখা
যায়। এইসব হিজড়াদের ছিবড়ি বলা হয়। এরা যৌনাঙ্গের ত্রুটিযুক্ত মহিলা নয়, সুস্থ-সবল মানুষ এরা। নিতান্তই অর্থনৈতিক কারণেই এরা হিজড়ের দলে এসে
যোগ দেয়। চরমতম আর্থিক সংকটের মধ্যেই দিন গুজরান করে। রুটিরুজির ধান্দায় এরা
হিজড়াদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। হিজড়াদের সঙ্গে থাকার কারণে এরা হিজড়াদের আদব-কায়দা
শিখে নেয়। রপ্ত করে নেয় হিজড়া সমাজের রীতিনীতি। এরা বেশিরভাই বিবাহিতা এবং স্বামী
পরিত্যক্তা হন।
(ঘ) ছিন্নি : যে সমস্ত ব্যক্তি লিঙ্গ কর্তন করে ‘খোজা’ হয়, তাদেরকেই ‘ছিন্নি’
বলে।হিজড়াদের গরিষ্ঠাংশই ছিন্নি। আকুয়া থেকে অনেকে হিজরাই
স্বেচ্ছায় ছিন্নিতে রূপান্তরিত হয়। যৌন পরির্তনকামী হিজড়ারা নিজেদের পুরুষাঙ্গ
কেটে ফেলে। শরীর থেকে পুরুষাঙ্গ কর্তন করে পরিপূর্ণ নারী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে
থাকে। আধুনিক বা অগ্রসর দেশগুলিতে অত্যাধুনিক প্ল্যাস্টিক সার্জারি করে যৌন
পরিবর্তনকামীরা তাদের লিঙ্গ পরিবর্তন করার সুযোগ পেতে পারে। এই জাতীয় অস্ত্রোপচার
অত্যন্ত ব্যয়বহুল, তাই এ স্বপ্ন অধুরাই থেকে যায়। তবে
যারা অসম্ভব রকমের মানসিক টানাপোড়েনকে উপেক্ষা করতে পারেন না, তারা হাতুড়ে চিকিৎসক দিয়ে লিঙ্গ কর্তন করিয়ে নেয়। অবশ্য যৌন
পরিবর্তনকামী আকুয়ারা ছাড়াও যৌনক্ষমতাহীন জেনানারাও অনেক সময় তাদের লিঙ্গ কর্তন
করায়। এছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দালাল মারফত পুরুষ-শিশু, কিশোর এবং যুবকদের হিজড়াদের গোষ্ঠীপতিরা সংগ্রহ করে। এরপর ওদের লিঙ্গ
কর্তন বা খোজা করে ‘পাকা হিজড়া’ বানিয়ে
তাদের বিভিন্ন রকম রোজগারের কাজে নামানো হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন